ভারত ইতিহাসে বারবার সংকটে পড়েই বড় আর্থিক পরিবর্তনের পথে হাঁটতে দেখা গেছে। ১৯৯১ সালের গভীর আর্থিক সঙ্কটই যেমন দেশটিকে অর্থনীতির উদারীকরণের দিকে নিয়ে গিয়েছিল।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের একতরফা শুল্ক নীতির ফলে। এর প্রেক্ষিতে অনেকেই মনে করছেন, ভারত আবার এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি কি এবার আবারো সংরক্ষণবাদের খোলস ছেড়ে আরও উন্মুক্ত বাণিজ্যের পথে এগোবে, নাকি প্রতিকূলতার ভয়ে পিছু হটবে?
ট্রাম্প বারবার ভারতকে ‘শুল্কের রাজা’ বলে সমালোচনা করেছেন। WTO’র তথ্য অনুযায়ী, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে গড় আমদানি শুল্ক ২.২ শতাংশ, চীনে ৩ শতাংশ ও জাপানে ১.৭ শতাংশ, সেখানে ভারতের হার ১২ শতাংশ—বিশ্বে অন্যতম সর্বোচ্চ।
এই উচ্চ শুল্কের ফলে ভারতীয়দের জন্য আমদানি পণ্যের দাম বাড়ে, আবার ব্যবসায়িক দিক থেকেও তা প্রতিযোগিতায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
যদিও পরিষেবা খাতে রফতানি বাড়ছে, তবুও ভারতের সামগ্রিক রফতানির পরিমাণ বিশ্ব বাজারে মাত্র ১.৫ শতাংশ। ব্যাপক বাণিজ্য ঘাটতির এই চিত্র যথেষ্ট চিন্তার।
তবে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপও দেখা যাচ্ছে। গত মাসে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের আগে ভারত আমেরিকার কিছু পণ্যের উপর শুল্ক কমিয়েছে। পাশাপাশি বাণিজ্য মন্ত্রী পীযূষ গোয়েল দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র সফর করে সম্ভাব্য বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চালিয়েছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের ঘোষণায় বছরে ভারতের ক্ষতি হতে পারে প্রায় ৭০০ কোটি ডলার, যার প্রভাব পড়বে গয়না, ওষুধ, গাড়ি এবং খাদ্যপণ্যে।
এই পটভূমিতে গোয়েল ব্যবসায়ীদের আহ্বান জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে।
ভারত এখন যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যান্ড, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে তৎপর। এমনকি এলন মাস্কের ‘স্পেস এক্স’-এর সঙ্গে ভারতীয় টেলিকম সংস্থাগুলোর চুক্তিও এই উদার দৃষ্টিভঙ্গিরই ইঙ্গিত দেয়।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ভারত যদি চীনের মতো বিশ্ব বাণিজ্যের বড় খেলোয়াড় হতে চায়, তবে শুল্ক কমিয়ে উন্মুক্ত বাজার গড়তে হবে। কারণ ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য এখনও তুলনামূলক দুর্বল। প্রতিযোগিতা ছাড়া কিছু শিল্প নিজেদের মধ্যেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, যা বিনিয়োগ ও দক্ষতা বাড়ানোর পথে বড় বাধা।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারসাম্য আনতে শুল্ক কমিয়ে ভারতের অংশগ্রহণ বাড়ানো দরকার। কারণ, বিশ্ব বাজারে ভারতের অংশ এতই কম যে চীনের মতো পাল্টা শুল্ক আরোপের ঝুঁকি ভারতের পক্ষে গ্রহণযোগ্য নয়।
এই পরিস্থিতিতে ভারত দাঁড়িয়ে আছে একটি মোড়ের মুখে। ক্লেয়ারমন্ট ম্যাককেনা কলেজের গবেষক অসীমা সিনহার মতে, ভারত চাইলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে নতুন বাণিজ্য কাঠামোর নেতৃত্ব দিতে পারে।
শুধু তাই নয়, দেশে চাকরির বিশাল ঘাটতি মেটাতেও এর প্রভাব পড়বে। ভারতের কৃষি খাত জিডিপির ১৫% দিলেও কর্মসংস্থানের ৪০% দেয়, যা খুবই অপ্রতুল উৎপাদনশীলতার ইঙ্গিত দেয়।
তবে শুল্ক কমালে এক বিপদও আছে—‘ডাম্পিং’। অর্থাৎ বিদেশি কোম্পানি সস্তায় পণ্য ঢুকিয়ে দেশীয় শিল্পকে ধ্বংস করতে পারে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে চীনের বিরুদ্ধে ‘নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার’ ব্যবহার করে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
সার্বিকভাবে, ভারতের সামনে এখন আবার সেই পুরোনো প্রশ্ন—সংকটের মুখে সে কি এগিয়ে যাবে, নাকি পিছিয়ে পড়বে?
Leave a Reply